অনলাইন ক্লাসের সমন্বয়হীনতায় সেশনজটের আশঙ্কায় শিক্ষার্থীরা
গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বশেমুরবিপ্রবি) একসময় চার বছরেই স্নাতক শেষ করা গেলেও বর্তমানে এক বছর, দেড় বছর এমনকি কিছু কিছু বিভাগের শিক্ষার্থীরা দুই বছরের সেশনজটের আশঙ্কায় রয়েছেন।
২০১৯ সালে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে তৎকালীন উপাচার্য খন্দকার নাসিরউদ্দিনের পদত্যাগের পর থেকেই বিভিন্ন বিভাগে বিভিন্ন দাবিতে শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন-ক্লাস বর্জন।
ইতিহাস বিভাগের আন্দোলনে প্রশাসনিক ও একাডেমিক ভবনে তালা লাগানো হলে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যহত হয়। এছাড়াও বিভিন্ন বিভাগের সাথে শ্রেণী কক্ষ দখলকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনা থেকে শিক্ষকের সাথে অসদাচরণের জন্য শিক্ষার্থীকে আজীবন বহিষ্কার করার শিক্ষক আন্দোলনেও থমকে গিয়েছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম। একের পর এক আন্দোলন ও ‘ভারপ্রাপ্ত’ অভিভাবকে চলা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন সেশনজট হওয়ার আশঙ্কা, ঠিক তখনই আশঙ্কাকে সত্য করেছে মহামারি করোনা। কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ রোধে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ন্যায় বিগত বছরের ১৭ মার্চ হতে বন্ধ রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
ভারপ্রাপ্তের ‘ভার’ মুক্ত করে উপাচার্যও নিয়োগ দেয়া হয়েছে বশেমুরবিপ্রবিতে। নতুন উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পেয়েই অধ্যাপক ড. এ.কে.এম. মাহবুব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প দ্রুত গতিতে এগিয়ে নিয়ে কুড়িয়েছেন প্রশংসাও। সেশন জট এড়াতে স্বভাবতই অনলাইন ক্লাসের দিকে পা বাড়ায় প্রশাসন। কিছু বিভাগে পুরোদমে অনলাইন ক্লাস চললেও কিছু বিভাগে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিলো অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম।
তবে অনলাইন ক্লাস চললেও এক প্রকার সেশনজট নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে শিক্ষার্থীদের ভাগ্যে। সেই অনলাইন ক্লাসও বন্ধ হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির প্রাপ্যতার তারিখ থেকে আপগ্রেডেশনের দাবিতে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি কর্মসূচির জন্য। গত ৬ এপ্রিল হতে সকল একাডেমিক এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয় বশেমুরবিপ্রবি শিক্ষক সমিতি। এতে অনলাইন ক্লাস কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়। যদিও লকডাউনের কারনে প্রশাসনের নির্দেশেই এই মুহুর্তে এমনিতেই বন্ধ রয়েছে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম।
সেশনজট নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের ২০১৮-২০১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী তুষার সরকার বলেন, “আমাদের বিভাগে অলরেডি ১ বছরের সেশনজট হয়ে গেছে। স্যাররা যদি এই করোনার সময়ে অনলাইনে রুটিন অনুযায়ীও ক্লাস নিতো তাহলেও অন্তত সেশনজটে পড়তে হতো না।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী আহমেদ মাসুদ বলেন, “আমরা তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা দুই বছর ধরে একই বর্ষেই রয়েছি। আমাদের শিক্ষকরা যদি অনলাইন ক্লাস ও এসাইনমেন্টের মাধ্যমে সেশনজটে বোঝাটা কমিয়ে নিতেন, তাহলে আমরা শিক্ষার্থীরা উপকৃত হতাম।”
তবে শুধু শিক্ষক আন্দোলন নই, বরং ছাত্রদের বিভিন্ন আন্দোলন-ক্লাস বর্জন থেকেই সেশনজটের বীজ রোপণ হয়ে করোনায় তা বৃক্ষ হয়েছে বলে মনে করেন অনেক শিক্ষার্থীই। তারা মনে করেন, বিভিন্ন বিভাগ নিজেরা আন্দোলন করেছে এছাড়া অন্যসব বিষয় যেমন- করোনা, লকডাউন, অনলাইন ক্লাস, শিক্ষক আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা সেশন জটে পড়েছে।
এই বিষয়ে ইতিহাস বিভাগের আন্দোলনের মুখপাত্র কারিমুল হক বলেন, “ভিসি বিরোধী আন্দোলনের পর থেকেই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন আন্দোলন, করোনার প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনলাইন ক্লাস নিয়ে অদূরদর্শীতা সব মিলিয়ে দেশের অন্য অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একাডেমিক কার্যক্রমে আমারা পিছিয়ে, যা বশেমুরবিপ্রবির সকল শিক্ষার্থীকে গভীর ভাবে সেশন জটের শঙ্কায় ফেলে দিয়েছে। আর এভাবে চলতে থাকলে একটা লম্বা সময়ের সেশন জটে পড়তে হবে আমাদের। যা আমাদের কোন ভাবেই কাম্য নয়।”
এদিকে এই সেশনজট কমাতে কি পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. কামরুজ্জামান বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় না খুললে সেশনজট কিভাবে নিরসন হবে সেটা বলা মুশকিল। তবে আমরা শিক্ষরা যেটা আলোচনা করেছি, আমরা যতদুর পারি ছুটি কমিয়ে ক্লাস চালিয়ে সেশনজট নিরসনের চেষ্টা করবো।”
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. সালেহ বলেন, “গত নভেম্বর থেকে করোনাকালীন মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতিতে আমরা ক্লাস নিয়েছি এবং প্রথম সেমিস্টার শেষ করেছি। এখন বিশ্ববিদ্যালয় লকডাউনের কারণে সরকারি নির্দেশনায় ক্লাস বন্ধ আছে। এছাড়া তিনি বলেন, অনলাইন ক্লাস ছাত্র ছাত্রীদের উপর তেমন প্রভাব রাখছে না। আমার পরিসংখ্যান থেকে বলছি, যখন কোনো ক্লাসে ১৫০ জন শিক্ষার্থী থাকে তখন ক্লাসে উপস্থিত হয় মাত্র ৩০-৩৫ জন। আমার বড় সংখ্যক শিক্ষার্থীকে ক্লাসে রিচ করাতে পারিনি।”
শিক্ষক সমিতির আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে অনলাইন ক্লাস বন্ধের বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ.কিউ.এম. মাহবুব বলেন, “অনলাইন ক্লাস কিছুটা বন্ধ আছে, কিছুটা খোলা আছে। দুই-চার দিনের ভেতর এটা ঠিক হয়ে যাবে। শিক্ষকদের সাথে আমি বসেছিলাম। শুধু শিক্ষকদের আন্দোলন নয়, সরকার ঘোষিত লকডাউনের কারণে প্রশাসন থেকে বন্ধ আছে। এটাও একটা কারণ। ২৪ এপ্রিলের পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
এদিকে অনলাইন ক্লাসের সঠিক ব্যবস্থাকরণের পাশাপাশি বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে সেশনজট থেকে মুক্ত হতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি শিক্ষার্থীরা দাবি জানিয়েছেন।